
রঙিন মিষ্টি আমাদের স্বাস্থ্যের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর। দোলের সময় বাজারে যে মঠ বিক্রি হয় সেখানে ব্যবহৃত রঙের গুণমান মারাত্মক খারাপ। আর এইসবের প্রভাবে হতে পারে ক্যানসার।
ফুচকা, যার নাম শুনলেই জিভে আসে জল, এমনকি তেঁতুল-মশলার মিশেলে এক সুঘ্রাণও নিমেষে টের পাওয়া যায়, সেই ফুচকাই বিপজ্জনক তকমা পেয়েছে। কারণ ফুচকার মধ্যে পাওয়া গিয়েছে ক্যানসার হতে পারে এমন কিছু উপকরণ অর্থাৎ কারসিনোজেনিক ইনগ্রিডিয়েন্টস। যেসমস্ত ক্ষতিকারক রাসায়নিকের খোঁজ পাওয়া গিয়েছে সেগুলি মূলত আকর্ষণীয় রং আনার জন্য ব্যবহার করা হয়। আর এর সবকটিই আমাদের স্বাস্থ্যের পক্ষে অত্যন্ত হানিকারক। সম্প্রতি কর্নাটকে খাদ্য সুরক্ষা দফতর অভিযান চালিয়ে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেছে। একথা ঠিক যে বাংলায় এখনও এই ধরনের কোনও সমীক্ষা হয়নি। কিন্তু তাই বলে কী এটা বলা যায় যে আমরা নিরাপদে রয়েছি? আর শুধু কী ফুচকা, তালিকায় রয়েছে আরও অসংখ্য খাবার যেখানে ‘ফুড কালার’- এর নামে দিনের পর দিন ব্যবহার হচ্ছে ইন্ডাস্ট্রিয়াল কালার, যা কিন্তু আদতে বেআইনি। হয়তো আজ ফুচকা খেলে বা ওইসব রঙিন খাবার খেলে হাতেনাতে কুফল পাবেন না আপনি, কিংবা পরের সপ্তাহেই ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে যাবেন না, কিন্তু দীর্ঘদিন এই জাতীয় খাবার খেতে থাকবে বিপদ অনিবার্য। শরীরের সমস্ত ধরনের কোষে ক্যানসারের প্রভাব বিস্তার করতে পারে এইসব ক্ষতিকারক রং বা কালার ইনগ্রিডিয়েন্টস।
কোন কোন খাবারে মূলত রং মেশানো হয়, সেইসব রং কীভাবে আমাদের ক্যানসার আক্রান্ত করতে পারে, সতর্ক থাকার জন্য আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কী কী করা উচিত- এইসব নিয়েই আমরা আলোচনা করেছিলেন ডক্টর সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়ের (অঙ্কোলজিস্ট)। দেখে নেওয়া যাক ঠিক কী কী তথ্য দিয়েছেন ডক্টর গঙ্গোপাধ্যায়।
শুধু ফুচকা নয় রঙের প্রভাব আরও অনেক স্ট্রিট ফুডে
ডক্টর গঙ্গোপাধ্যায় প্রথমেই বলেছেন যে কোন খাবারে কী রং দেওয়া হচ্ছে, সেটা ভালভাবে পরীক্ষা করে অবশ্যই দেখা প্রয়োজন। ফুচকার ক্ষেত্রে মূলত রং মেশানো হয় তেঁতুল জলে। যেমন আজকাল দেখা যায় ফুচকা পরিবেশন করা হচ্ছে এক ধরনের সবুজ জল দিয়ে। একঝলক দেখলে পুদিনা মেশানো মনে হলেও আসলে ওতে থাকে রং। ডক্টর গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায়, এডিবেল কালার বা খাওয়ার উপযুক্ত যেসব রং রয়েছে তার দাম অনেক বেশি। বিদেশে খাবারে এই রং দেওয়া হয়। তার ফলে দামও হয় বেশি। এমনকি প্যাকেটের গায়ে লেখাও থাকে কোন রং কতটা পরিমাণে ব্যবহার হয়েছে। তবে আমাদের এখানে সেইসবের বালাই নেই। আর যেহেতু প্রতিযোগিতা তুঙ্গে তাই এডিবেল কালার প্রায় কেউই ব্যবহার করেন না। তার বদলে দেওয়া হয় ইন্ডাস্ট্রিয়াল কালার যা আদলে অত্যন্ত ক্ষতিকারক রাসায়নিক, খাওয়ার উপযুক্ত কোনওভাবেই নয়। আর এডিবেল কালার ফুচকার জলে দিলে দাম তো দু-তিন গুণ বেড়ে যাবে, লোকে খাবে না। অতএব ব্যবসা বাঁচাতে রঙের গুণমানে আর খেয়াল থাকে না।
শাকসবজি থেকে ফল, কাবাব থেকে বিরিয়ানি- ক্ষতিকারক রাসায়নিক রয়েছে সর্বত্র
বাজারে গেলে আজকাল দেখা যায় গাঢ় সবুজ রঙের শাকসবজি। রাঙা আলুর গায়ে গাঢ় গোলাপি রং। বেগুন বেশ কালচে বেগুনি। আম, লিচু সবেতেই নজর কেড়ে নিচ্ছে রং। সবই কিন্তু রাসায়নিকের খেলা। এমনকি সবজি কিংবা ফলের আকার বৃদ্ধি করার জন্য চাষের সময়েই স্প্রে করা হয় বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক। এছাড়াও কীটনাশক তো রয়েইছে। আর এই সমস্ত ধরনের রাসায়নিকেই লুকিয়ে রয়েছে মারণরোগের বীজ, জানাচ্ছেন ডক্টর গঙ্গোপাধ্যায়।
এবার আসা যাক বিরিয়ানির কথায়। আজকাল দু’পা এগোলেই একটা করে বিরিয়ানির দোকান। লাল শালুতে মোড়া বিশাল হাঁড়ি। ম ম করে সুগন্ধ। এড়িয়ে যাওয়া সত্যিই মুশকিল। কিন্তু ৪০ কিংবা ৫০ অথবা ৬০ টাকার বিরিয়ানির প্লেটে তো আর জাফরান দিয়ে রং আনা সম্ভব নয়। ফলে মেশানো হয় হলুদ রং যা খাওয়ার যোগ্য নয়। নামকরা হোটেল, রেস্তোঁরার ক্ষেত্রে বিরিয়ানির দাম দেখে আশা করা যেতে পারে যে ভেজাল কম। কিন্তু নিশ্চয়তা নেই। শুধু কী বিরিয়ানির রং, সন্দেহ থাকে মাংসের গুণমান নিয়েও। অতএব সস্তার বিরিয়ানিতে যতই লোভ লাগুক তা থেকে শতহস্ত দূরে থাকার পরামর্শই দিয়েছেন ডক্টর গঙ্গোপাধ্যায়।
যাঁরা ডায়েট করেন তাঁদের অনেকেই কাবাব খান। মাংস পোড়া হোক বা ভাজা- সবই কারসিনোজেনিক, জানালেন ডক্টর গঙ্গোপাধ্যায়। এখানে ইন্ডাস্ট্রিয়াল কালারের ফাঁদ নেই। কিন্তু মাংস ভাজলে বা পোড়ালে এবং সেই খাবার নিয়মিত খেলে, দীর্ঘদিন ধরে খেলে- ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।
উৎসবের মরশুমে রঙিন মিষ্টি
দোলের সময় বাজারে দেদার বিক্রি হয় মঠ। এছাড়াও পুজো-পার্বণের মরশুমে প্রায় সমস্ত মিষ্টির দোকানে থাকে রঙিন সন্দেশ। আজকাল তো রসগোল্লাতেও রং দেখা যায়। অথচ এইসব মিষ্টিতে কী ধরনের রং ব্যবহার হয় তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। বড় মিষ্টির দোকান হলে তবু আশা করা যেতে পারে যে তাঁরা হয়তো খাওয়ার উপযুক্ত রং দিয়ে মিষ্টি তৈরি করেন। কিন্তু ছোটখাটো দোকান তো প্রতিযোগিতাতেই পিছিয়ে যাবে। যদি এডিবেল কালার ব্যবহার করতে হয় তাহলে মিষ্টির দাম দু থেকে তিনগুণ বেড়ে যাবে। ব্যবসা মার খাবে। অতএব এখানেও সেই ফাঁদ রয়েছে ইন্ডাস্ট্রিয়াল কালারের, বলছেন ডক্টর গঙ্গোপাধ্যায়। খাবার হয়তো লাল রং করতে হবে, একটু রেডক্সাইড মিশিয়ে দেওয়া হল। স্বাদের বিশেষ হেরফের হবে না। অথচ ক্ষতিকারক রং আমাদের শরীরে প্রবেশ করে যাবে।
ডাক্তারবাবুর কথায় দোলের সময় যে মঠ পাওয়া যায় সেখানে ব্যবহৃত রং আর মিষ্টির দোকানে (মূলত ছোট ব্যবসায়ী) সাজিয়ে রাখা দরবেশে যে রং ব্যবহার করা হয় তা আমাদের স্বাস্থ্যের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর। তাই রং দেওয়া মিষ্টি থেকে যত দূরে থাকা যায় ততই মঙ্গল। খাবারে ব্যবহৃত রঙের থেকে ক্যানসার হওয়ার প্রবণতা তাহলে কিছুটা হলেও এড়ানো যাবে। আর খুব কড়া ধাঁচের মিষ্টি যেখানে ‘অ্যাডেড সুগার’- এর পরিমাণ অতিরিক্ত সেগুলিও খেতে বারণ করেছেন ডক্টর গঙ্গোপাধ্যায়। কারণ এই অতিরিক্ত ‘সুগার ইনটেক’ কার্যত আমাদের শরীরে ক্যানসারকে ডেকে আনে। তাই হলুদ, সবুজ রঙের মিষ্টি না খাওয়াই ভাল। অন্য মিষ্টি খাওয়া তুলনায় শ্রেয়।

স্ট্রিট ফুডে যে ধরনের ইন্ডাস্ট্রিয়াল রং মেশানো হয় তার থেকে কোনও নির্দিষ্ট ধরনের ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে নাকি শরীরের যেকোনও অংশের কোষ আক্রান্ত হতে পারে
ডক্টর গঙ্গোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ইন্ডাস্ট্রিয়াল কালার মানবশরীরে অনেকদিন ধরে প্রবেশ করতে থাকলে ক্যানসার শরীরের যেকোনও জায়গায় হতে পারে। বিশেষভাবে বাচ্চাদের খাদ্যাভ্যাসের দিকে নজর দিতে বলেছেন ডাক্তারবাবু। তাঁর কথায় বাচ্চারা যদি অল্প বয়স থেকে স্ট্রিট ফুড খাওয়াতে অভ্যস্ত হয় তাহলে অনেকদিন ধরে এইসব খারাপ রাসায়নিকগুলি শরীরে প্রবেশ করায় তাদের মধ্যে ক্যানসার হওয়ার প্রবণতা বাড়তে পারে। শরীরের বিভিন্ন অংশের কোষগুলিকে এমনভাবে উন্মুক্ত করে দেয় যে সেগুলি সহজে ক্যানসার আক্রান্ত হতে পারে। ক্ষতিকারক রংগুলি যেহেতু আমাদের শরীরে শোষিত হয় তার মাধ্যমে মানবদেহের যেকোনও অংশের কোষই ক্যানসার আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করে।
এতক্ষণ ধরে যা পড়লেন নিঃসন্দেহে আতঙ্ক ধরে গিয়েছে, সতর্ক থাকার জন্য কী কী পরামর্শ দিচ্ছেন ডাক্তারবাবু
ডক্টর গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায়, স্ট্রিট ফুড খাবেন না বললে কেউ শুনবে না। আমি যেটা বলি যে মাঝেমধ্যে খান। ওইটুকু প্রতিরোধ ক্ষমতা আমাদের সকলের শরীরেই থাকে। কিন্তু দিনের পর দিন খেলেই মুশকিল। সেক্ষেত্রে লোভ সংবরণ প্রয়োজন। সুস্থ থাকার জন্য ভরসা রাখুন বাড়ির খাবারে। অনলাইনে খাবার অর্ডার করলেও একটু স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খাওয়া উচিত। অতিরিক্ত তেল, ঝাল, মশলা এবং অতি অবশ্যই রঙিন খাবার থেকে দূরে থাকুন। কমলাভোগ, হলুদ রঙের রাজভোগ, দরবেশ, মঠ- এগুলো একেবারেই খাবেন না। বদলে অন্য মিষ্টি খান, তবু মন্দের ভাল। এছাড়াও রেস্তোরাঁয় অনেক খাবারের গ্রেভি তৈরিতেও রং ব্যবহার হয়। তাই সেগুলিও এড়িয়ে চলুন। মাঝেমধ্যে স্ট্রিট ফুড, কাবাব, বিরিয়ানি সবই খেতে পারেন। কিন্তু রঙিন খাবার থেকে বারংবার দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন ডক্টর গঙ্গোপাধ্যায়। আর বাজার থেকে কাঁচা সবজি, ফল এগুলো কিনা এনে অন্তত আধঘণ্টা (৩০ মিনিট) গরম জলে ভিজিয়ে রাখুন। তারপর রান্না করুন বা খান।
Credit – bengali.abplive.com